Monday, February 6, 2012

অন্ধকারাচ্ছন্ন জ্যোতির্ময়

সে পর পর দু'টো সিগারেট খেয়ে নিঃশেষ করল দ্রুত।

সিগারেটকে অসময়ের সঙ্গী বলা হয়, ফুসফুস ক্যান্সারের কারণও বলা হয়। এই মূহুর্তে তার সময় বলে কিছু নেই, ফুসফুস বলে একটা কিছু সম্ভবত আছে, হয়তো কাজও করছে, কিন্তু কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে তার হৃদপিন্ড; ভবিষ্যৎটুকু হারিয়ে ফেলেছে তার আজন্ম অন্ধকারাচ্ছন্ন বেঁচে থাকার বাসনা, সামান্য যে আলোর আশাটুকুর জন্য সে গত আট বছর ধরে বেঁচে ছিল, হঠাৎই ভীষণ ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে সেই আলোকছটাটুকু, অন্ধকারেই পতিত হয়েছে আবার সবকিছু, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তার যাপিত জীবন। এখন ফুসফুস ক্যান্সার হোক, বা ব্লাড ক্যান্সার হোক, খুব বেশি কিছু এসে যায় না তাতে তার আর, জীবনকে বড় তাচ্ছিল্য করতে শিখেছে সে গত আট বছর ধরে, এটার চেয়ে মূল্যহীন তার কাছে এখন আর কিছু নেই। এই আট বছর তার জীবনের অন্ধকার সময়, এখনো আলো নেই, সে জানে কখনো আলো আসবে না, তবু নিজেকে জ্যোতির্ময় ভাবতে তার ভাল লাগে, সে জানে সে জ্যেতির্ময়, এই পৃথিবীর খুব অল্প ক'জন সৌভাগ্যবান জ্যোতির্ময়গণের সে একজন। তবু তার জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন কেন সবসময়? আসুন না, কিছুক্ষণের জন্য একজন অন্ধকারাচ্ছন্ন জ্যোতির্ময়ের তীব্র অনুভূতিশীল মূহুর্তগুলোতে ঘুরে আসি, দেখে আসি আঁধারের স্বরূপ। এ গল্প আমরা শুনব তার মুখ থেকেই।

আমার শৈশব সুখকর ছিল না, আমার শৈশব ছিল নিরানন্দ একরাশ কুয়াশাচ্ছন্ন মূহুর্তের সমষ্টি, পুরোনো ঢাকার স্যাঁতস্যাঁতে এক গলির আরো স্যাঁতস্যাঁতে এক একচালা ঘরে কেটেছে আমার ব্যর্থ বিষণ্ন শৈশব। আমার দরিদ্র বাবার অনেক ক'টি সন্তান ছিল, আমি ছিলাম তাঁর সপ্তম এবং সর্বশেষ সন্তান। ছয় ভাই এক বোনের সে বিশাল সংসার চালাতে গিয়ে আমার বাবার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল, আমার আগমণ তাই তাঁর পরিবারে, অথবা এই পৃথিবীর কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহন করেনি কখনো। আমাদের সেই একচালা ঘরে পাঁচটা খুপরির মতো কামরা ছিল, ছিল না বলার মতো কোন আসবাব, বহু বছর আমরা শিখিনি wardrobe কী জিনিস, ফ্রিজ বা টেলিভিশন কী জিনিস, বা টেলিফোন কী জিনিস।
আমার বাবার কার্ডে 'যোগাযোগ' এর জায়গায় লেখা ছিল 'দূরালাপনী', এবং সেখানে আমাদের এক আত্নীয়ের টেলিফোন নাম্বার দেয়া ছিল। ফোন এলে সেই আত্নীয়ের বাসা থেকে বিরক্ত মুখে কেউ একজন পনের মিনিট পরে করতে বলে আমাদের বাসায় এসে খবর দিলে বাবা ঘামতে ঘামতে পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে ছুটে যেতেন সেই ফোন কল ধরার জন্যে। আমাদের জন্য ব্যাপারটা কম আনন্দের ছিল না, কারণ, ঐ আত্নীয়ের বাসায় বাবা শুধু ফোন ধরতেই যেতেন না, সেখানে তিনি অনেক্ষণ ধরে টেলিভিশন দেখতেন, আর গল্পগুজব করতেন। আমাদের সবচেয়ে ছোট তিন ভাইবোনের তখন মহোৎসব শুরু হত, পড়ার বইগুলোকে তখন উল্টে রেখে অনাকাঙ্খিত ও অপ্রত্যাশিত প্রাপ্ত সময়ের সদ্ব্যাবহারে কার্পণ্য করতাম না আমরা।

আমার বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন, আমার জন্মের বেশ আগে থেকেই তিনি বড় ধরণের ঝামেলায় জড়িয়ে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা ধরেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে সেই ব্যবসায় লাভের মুখ না দেখেই থাকতে হয়। তাঁর ছোট্ট করে ছাপানো একটা visiting card ছিল, সেই কার্ড খুব বেশি মানুষকে তিনি দিতে পারেন নি, আসলে দেয়ার প্রয়োজনই পরেনি; তিনি কয়েকটি কাঠপেন্সিল রঙের বাক্সে বন্দী করে রাখেন সেই কার্ড। প্রথম যখন আমি পড়তে শিখি, তখন সেই কার্ডগুলো আমার খেলার সাথী হয়। বাবার ছাপানো জিনিসের প্রতি একটা মোহ ছিল, কার্ড ছাড়াও, অপ্রয়োজনেই, তিনি তাঁর একটি business pad ছাপিয়েছিলেন, সেই কাগজগুলো সাধারণ কাগজের চেয়ে মোটা ছিল; মা উৎসবের দিনগুলোতে কেক চাপাতেন চুলোয়, অব্যবহৃত সেই প্যাডের কাগজগুলো দিয়ে দেয়া হতো কিনার দিয়ে, যেন লেগে না যায়। ছাপানো অক্ষরে বাবার নাম পড়তে তখন আমার বেশ লাগত, মনে হত আমার বাবা অনেক বড় কেউ, যাঁদের ছবি এবং নাম ছাপানো অক্ষরে খবরের কাগজে আসে।

আমাদের খুপরির মতো পাঁচটি ঘরের একটিতে থাকতেন মা-বাবা, একটিতে আমার বোন, একটিতে আমরা ছোট দুই ভাই, আর একটিতে আমাদের বড় দুই ভাই; আর একটি ছিল আমাদের 'অফিস ঘর'। আমরা সেখানে সন্ধ্যে মিলানোর পর পড়তে বসতাম, বাবার কাছে লোকজন এলে সেখানে বসতে দেয়া হতো, আর এখনকার 'ড্রয়িং-রুম' বলতে আমরা যা বুঝি, শ্রীহীন সেই অফিস ঘরটি সেইসব কাজেই ব্যবহৃত হতো। সেখানে কোন সোফাসেট ছিল না, ছিল শুধু একটি পা-ভাঙা টেবিল আর কয়েকটি কাঠের চেয়ার। আমাদের বাড়িতে কোন সুদৃশ্য সোফাসেট ছিল না, ছিল না বলার মতো কোন আসবাব-পত্র; আমাদের আসবাব ছিল পুরোনো কিছু চকি, একটা ভেঙে যাওয়া বক্স-খাট, কয়েকটা চেয়ার, একটি বইয়ের আলমারি, একটি কাগজপত্র রাখার আলমারি আর কয়েকটি বুক-শেলফ। আমাদের ছোট্ট এক চিলতে একটি উঠোন ছিল, সেখানে সগর্বে মাথা উঁচু করে ছিল একটি নারকেল গাছ। প্রায়ই এক বৃদ্ধ এসে সেখান থেকে নারকেল পেড়ে দিত, মা তখন সেগুলো কুড়ে দিতেন, আমরা ছোট তিন ভাই বোন সেগুলো মুড়ি দিয়ে চামচে করে খেতাম।

আমার সবচয়ে বড় ভাই তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন, চট্টগ্রাম বিআইটিতে, মেজভাই পড়তেন তাঁর দুই ক্লাশ নিচে, রাজশাহী বিআইটিতে। আমার বাবা তাঁদের দুজনের পড়াশোনার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন এক অর্থে, আর তাঁদের পরের ভাইদের জন্য যে বাবার মমতা ছিল না এমনটা না হলেও, তিনি কিছুটা অপারগতাই প্রকাশ করতেন। আমার মা পুরোনো ঢাকার এক বালিকা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, আমার বোন তাঁর স্কুলেই পড়াশোনা করত। নিদারুণ অর্থ কষ্টের জন্য বাবা-মা কোনদিন আমাদের নিয়ে যাননি শিশুপার্কে বা মেলায়, কিনে দিতে পারেননি শিশুতোষ অনেক কিছু, যেগুলোর দুঃখ এ জীবনে কোনদিন হয়তো ভুলতে পারব না। মনে আছে, একদিন পাশের বাসার একটা ছেলেকে বাটিতে করে দই দিয়ে মুড়ি খেতে দেখে খুব সখ হয়েছিল দই-মুড়ি খাওয়ার; এই দাবীতে কান্না জুড়ে দেয়ার পর অনেক্ষণ বাবা-মাকে দেখেছিলাম দুঃখ দুঃখ মুখ করে সেই কান্না সহ্য করার, তারপর এসে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। মা বলছিলেন- দুই টাকার দই আনলেই তো হয়, একটু নিয়ে এসো না, বাচ্চাটা কতক্ষণ ধরে কাঁদছে! বাবা বলছিলেন- আজকে চাল, তেল, নুন আর ডাল সিরাজের দোকান থেকে বাকি এনেছি, নয়শ টাকা বাকি পড়েছে, সিরাজ কাল থেকে আর বাকি দিবে না বলে দিয়েছে, আর আমার ছেলে রাজপুত্র হয়েছে? দই খেতে সখ করেছে তার? লাথি দিয়ে পেট গালিয়ে দেয়া দরকার, তাহলে আর দই খেতে ইচ্ছে করবে না।
আমার স্মৃতিশক্তি ভালো ছিল, বাবার সেদিনের যন্ত্রণা মিশ্রিত রাগত কন্ঠস্বর আমি গত বাইশ বছরে ভুলিনি, আরো দু'হাজার বছরেও হয়তো কখনো ভুলব না।

আমাদের সংসার কাটতো অনেকটা ঠেলাগাড়ির চাকার মতো, একটু ধাক্কা দিলে বা একটু টান দিলে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ভার নিয়েও যেমন ঠেলাগাড়ি তার চালকদের পেটের দিকে তাকিয়ে দয়া পরবশ হয়ে সামান্য নড়ে ওঠে, আমাদের সংসারটাও বাবার কোনদিন আনা টাকায় এবং কোনদিন না আনা টাকায় একটু একটু করে চলত। কেমন করে মাস যেত আমার ধারণার বাইরে ছিল সেটা, শুধু মনে পড়ে, গভীর রাতে আমার বোনের পাশে শুয়ে থাকতাম, সিনড্রেলার গল্প বলতে বলতে যখন আমার গল্পকথক মমতাময়ী বোনই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত, আমি তখন প্রায়ই জায়নামাজে বসে বাবার অশ্রুভেজা কন্ঠের প্রার্থনা শুনতে পেতাম। সৃষ্টিকর্তাই নাকি সন্তান দেন, অথচ কেন সেই সন্তানদের ভরণ পোষণ করার ক্ষমতা দেন না, এই নিয়ে বাবার আক্ষেপ শুনতে শুনতে ঘুমুতাম, খুব ভোরে একই প্রার্থনা শুনে ঘুম ভাঙত, বাবা তখন ফজরের নামাজে বসতেন।

খুব বেশিদিন এভাবে কাটল না বাবার, আমার বড় ভাই চট্টগ্রাম বিআইটি থেকে পাশ করে বেরুলেন, বড় চাকরি নিলেন। আমার বয়স ততদিনে সাত বছর পেরিয়েছে, স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়তাম, আমার মা আমাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, আমাকে নাকি কোরানে হাফেজ হতে হবে। মাদ্রাসায় ঠিক নিজের ইচ্ছেয় আমি যাইনি, তবে অমতও করিনি বাবা-মার, স্কুলের বেতন বাকি পড়েছিল প্রায় এক বছরের, এমনিতেও হয়তো আর যেতে পারতাম না স্কুলে। মাদ্রাসায় প্রথম দিন খুব বিচিত্র লেগেছিল, স্কুলের মতো অনেকগুলো বই সেখানে নেই, একটাই কায়দা, সেটা পাশ করলে একটাই আমপারা, সেটা পাশ করলে একটাই কোরান শরীফ, প্রথমে নজরানা, তারপর হিফজ। ধীরে ধীরে মানিয়ে নেই আমি সেই পরিবেশের সাথে, আস্তে আস্তে ভালো লাগতে থাকে গৃহত্যাগী হোস্টেল জীবন, প্রচন্ড শীতের গভীর রাতে উঠে অজু করতে যেতে ভালো লাগতে শুরু করে; খুব কাছে বাসা থাকলেও একসময় ধীরে ধীরে কমিয়ে দেই আমি বাসায় ফেরা, একটা সময় আসে যখন বাসার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ আমি বিচ্ছিন্ন করি। সারাদিন মাদ্রাসায় থাকতাম, মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম, দ্রুত কায়দা-আমপারা-নজরানা শেষ করে হিফজ ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাদ্রাসায় সবচেয়ে খারাপ লাগা ছিল একটাই, বাসার মতো কয়েকটা শেলফ আর একটা আলমারি ভর্তি প্রচুর বই সেখানে নেই, খুব ছোট থাকতেই যেই বইগুলোর সাথে আমার আমৃত্যু বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল।

বই পড়ার সুযোগ ছিল না, কিন্তু ক্রিকেট খেলার সুযোগ ছিল বিকেলে, ক্রিকেট তখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। শচীন টেন্ডুলকার বা ব্রায়ান লারা বা স্টিভ ওয়াহ হয়ে ওঠে আমার স্বপ্নের নায়ক, কখনো কখনো মার্ক বাউচার বা ইয়ান হিলি হয়ে আমি উইকেট কিপিং করতে শুরু করি বিকেলগুলোতে। বাসার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি তখন, প্রায়ই মাদ্রাসা ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে যাই, মাদ্রাসায় ফিরে এসে প্রচন্ড মার খাই, পুরো পিঠে দগদগে ঘা নিয়ে তিনতলার চিলেকোঠায় পাঞ্জাবী খুলে বসে থাকি, অন্ধকারে মশার ঝাঁক এসে ঐ আহত পিঠ থেকে রক্ত শুষে নেয়, কিছু বলি না, অন্ধকারে চুপচাপ আকাশের লক্ষ লক্ষ তারার দিকে তাকিয়ে কখনো ভাবি, তবু যদি বাবা-মা সুখে থাকেন তো ভাল। সেই ঘা শুকোতে না শুকোতেই তেল চিকচিকে বেতের প্রচন্ড আঘাত আবারো আমাকে আহত করে দেয়, আমার ছোট্ট পাঞ্জাবীগুলোর পেছনের দিকগুলোতে লেগে থাকতে শুরু করে চাপ চাপ রক্ত, আমার ছোট্ট হাতে ঐ পাঞ্জাবী ধুয়ে সেই রক্তের কালচে দাগ মুছে ফেলা অসম্ভব হয়ে ওঠে আমার জন্য।

মাদ্রাসায় পড়াটা আমার জন্য তখন যথেষ্ট আনন্দময় হলেও, কিছুটা বড় হয়ে বুঝতে শুরু করি মানুষের তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞাটুকু আমাদের প্রতি। আমাদের বয়েসী সবাই ক্রিকেট খেলুক, কাদা ছিটিয়ে ফুটবল খেলুক, তাতে বাধা নেই; আমরা খেললেই পৃথিবী জুড়ে শুনতে পেতাম ভয়ঙ্কর অবজ্ঞা- 'হ্যাঁহ! মাদ্রাসায় পইরা হুজুর হইতাসে, আবার খেলতে আসে!' অবধারিত ভাবে প্রতিদিন বিচার যেত মাদ্রাসার হুজুরদের কাছে, এবং প্রতি সন্ধ্যাতেই হুজুররা আমাদের নিয়ে বসতেন, অতি ভাগ্যবান কেউ কেউ মিথ্যে বলে বেঁচে যেত, আমি মিথ্যে বলতে পারতাম না, তাই আমাকে স্বীকার করতে হত যে আমি খেলতে গিয়েছিলাম, এবং 'শয়তানের কাজ' করার জন্য শাস্তি পেতে হত। শাস্তির প্রকারভেদ ছিল, একটা ছোট্ট নমুনা দেই- সুলেমান ভাই(মাদ্রাসার বাবুর্চি কাম খেদমতগার) আমার পাজামা-পাঞ্জাবী খুলে দিয়ে নগ্ন করে নিতেন, হাতে সামান্য পানি নিয়ে আমার ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত শরীরের পেছন দিকটাতে সরিষার তেল লাগিয়ে দিতেন। এরপর দু'জন ভীষণ শক্তিশালী স্বাস্থ্যবান হুজুর আমার দু'হাত এবং দু'পা গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিতেন, করজোড়ে বাঁধা হাতের গামছার একপ্রান্ত বাঁধা হত বড় হুজুরের ঘরের এক দিকের পিলারে, দু'পা একত্রে বেঁধে রাখা গামছার একপ্রান্ত বাঁধা হত আরেকটা পিলারে। আমার মুখ-বুক-পেট নিচের দিকে থাকত, শূণ্যে ভেসে থাকতাম আমি। হুজুর দু'জন তখন হাতে দুটো সরু বেত নিতেন, পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে দুজন আমার দু'পাশে দাঁড়িয়ে সপাং সপাং করে বাড়ি দিতেন, আমার চিৎকার করে মুখে রক্ত ফেনা তুলে ফেলা ছাড়া অন্য কোন কিছু করার থাকত না। শাস্তি গুরুতর হলে আধাঘন্টা চলত এই অত্যাচার, মাঝারি হলে পনের মিনিট, এবং ছোট শাস্তি হলে পাঁচ থেকে দশ মিনিট। প্রায় অচেতন অবস্থায় সুলেমান ভাই আমাকে নামিয়ে নিয়ে যেতেন, জামা কাপড় পড়িয়ে গুদাম ঘরে ফেলে রাখতেন, নিজ থেকে সুস্থ হয়ে মূল ভবনে আসার আগ পর্যন্ত খাবার দাবার দেয়া হত না।

এই শাস্তি শুধু আমাকেই না, আমাদের মাদ্রাসায় পড়া অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে। শুধু ভোগ করতে হতো না তাদের, যাদের বাবা বা অভিভাবকগণ মাদ্রাসায় অনুদান পাঠাতেন। কত কিছুর জন্যেই শাস্তি পেতে হত, কখনো 'সবক' তৈরী না করার জন্যে, কখনো 'সাত-সবক' এর জন্য সময় মতো লাইন না দেয়ার জন্যে, কখনো 'আমুখতা' 'ইয়াদ' না করে আসার জন্যে, কখনো চার আলিফ টান কে এক আলিফ পরিমাণ টানার জন্যে- মাদ্রাসাটা ছিল আমার কাছে একটা torturing cell এর মতো। আর এছাড়া, খবরের কাগজ পড়তে যাওয়া, দেরী করে ঘুমানো, বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়া, বাথরুমে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকা, পড়তে বসে ঝিমানো, টুপি ছাড়া হাঁটা, রাস্তার পাশের দোকানে টিভিতে খেলা দেখতে যাওয়া- অপরাধের শেষ ছিল না, সেখানে সবকিছুকে ভয় পেতে শিখেছিলাম আমি খুব ভালো করে। মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় পেতাম, কোথাও যেতে ভয় পেতাম, কিছু খেতে ভয় পেতাম, কোন কিছু করতে ভয় পেতাম; সবসময় একটা তীব্র ভয়, একটা জঘন্য আতঙ্ক আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত, একটা পা ফেলার আগেই মনে পড়তো আমার তৈলাক্ত নগ্ন পৃষ্ঠদেশে অবিরাম অসহ্য যন্ত্রণাময় নির্মম আঘাত; মনে পড়তো কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে করতে মুখ দিয়ে রক্ত মিশ্রিত ফেনা বের করে ফেলা অপরাবাস্তব পৈশাচিক মূহুর্তগুলো, এই সময়টাতেই আমি পরিণত হয়ে উঠি অনেক বেশি, আমার বয়েসি যে কারো চেয়ে আমি অনেক ধীর স্থির হয়ে উঠি, অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে শিখি, অনেক ঋদ্ধ হয়ে উঠি, অনেক বেশি বুঝে ফেলি জীবনটাকে।

আমার বাসায় এদিকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়, দীর্ঘ আট বছরে বদলে যায় অনেক কিছুই, আমার বাবার ব্যবসার অবস্থা পরিবর্তিত হয়, আমাদের বাসায় টেলিফোন কেনা হয়, ফ্রিজ কেনা হয়, ডিপ ফ্রিজ কেনা হয়, সোফাসেট কেনা হয়, wardrobe কী সেটা চিনতে পারি, আমাদের সেই একতলা অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে খুপরির মতো ঘরগুলো ভেঙে সেখানে মোটামুটি রকম একটা তিনতলা বাড়ি দাঁড়া করানো হয়। আমার বড় তিন ভাই ততদিনে বিয়ে করেন, বড় ভাই চলে যান দেশের বাইরে, মোটামুটি সেখানেই তিনি স্থায়ী হয়ে যান; ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তিনি বাবা-মাকে ঘুরতে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানান, প্লেনের টিকেট থাকে সেই আমন্ত্রণ পত্রের সাথে। একদিন বাসায় বসে শুনি, আমার বাবা আমার খালাকে টেলিফোন করে সুখী মানুষের কন্ঠে বলছেন- আপা, আমার সুখের দিন শুরু হল।

না, বাবার সুখের দিন শুরু হয়নি তখনো। ক্যালিফোর্নিয়া বেড়াতে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের এক মধ্যদুপুরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাঁর দু'টি কিডনিই, হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি আমার ভাইকে এম্বুলেন্সেই বলে উঠেন- 'আমি তো বাঁচব না, শেষ কয়েকটা ঘন্টা বাসায় থেকে যাই, আমাকে বাসায় নিয়ে যা। হাসপাতালে যাব না রে।' আমাকে মাদ্রাসা থেকে খবর দিয়ে আনা হয়, এ ধরণের ক্ষেত্রে মানুষকে সান্তনা দেয়ার কথা, কিন্তু বাঙালির কপটতা অসীম, আমি মাদ্রাসার তালেবুল এলেম, 'বাবা' বলে কিছু আমার থাকতে নেই; আমাকে সূরা-ইয়াসিন পড়তে বলা হয় বাবার কানের কাছে। আমার চিৎকার করে তখন বলতে ইচ্ছে করছিল- একটা মানুষ মারা যাচ্ছে, তাঁর কানের কাছে বসে সূরা-ইয়াসিন পড়ে তাকে কি এটা মনে করিয়ে দেয়া খুব দরকার যে তোমার সময় শেষ হয়ে এসেছে? তোমাদের ভেতর যে কেউ তো এই মূহুর্তে আমার বাবার আগে মারা যেতে পার বিনা নোটিশে, তোমার কানের কাছে কি কেউ এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে? যদি দিত, তাহলে তোমার কেমন বোধ হত? ফাঁসির আসামীকেই মৃত্যুর আগে থেকে তওবা করিয়ে মৃত্যুর জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করা হয়, আমার বাবা তো ফাঁসির আসামী না, কেন তাকে এভাবে আমি মনে করিয়ে দিব মৃত্যুর কথা?

বাঙালি ধর্মান্ধ জাতি, এদের ধর্মবোধ বিচিত্র, তাই উপস্থিত সুধীজন কেউকেই নিরাশ করলাম না আমি, বাবার প্রতি আমার যতটুকু আবেগ ছিল ততটুকুকে মুছে ফেলে জোরে জোরে সূরা-ইয়াসিন পাঠ করে গেলাম। বাবা একবার চোখ খুলে খুব ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, দীর্ঘ একটা মূহুর্ত আমরা পিতা-পুত্র অপলক ছিলাম একে অন্যের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি বাবার আমাকে বহু বছর আগের কোন সন্ধ্যায় দই কিনে না খাওয়াতে পারার আক্ষেপ ছিল, নাকি আমার জন্য কোন উপদেশ ছিল, নাকি শুধুমাত্র বাঁচার আকাঙ্খা ছিল সেটা আমি বুঝতে পারিনি, একটু চুপ করে আসলেই কানের কাছে কোন এক ধর্মান্ধ কপট চেঁচিয়ে উঠছিল, 'আরে বাবা! জোরে পড় না সূরাটা। বাপ মরণের সময় একটু সূরা শুনার লাইগ্যাই তো তোমারে কোরানে হাফেজ বানাইসে।' প্রচন্ড রাগে দাঁত কিড়বিড় করে উঠলেও কিছু বলি নি শুধু ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া ঐ ধর্মান্ধটাকে, আমার বলার সময় তখনো আসেনি।

রাত ন'টা পনের মিনিটে বাবা 'বাতাস! বাতাস!' বলে চিৎকার করতে করতে চোখ উল্টে কাত হয়ে পড়েন, আমি তখন বাবার হাত ধরে বসে ছিলাম, অনেক্ষণ আমি নিশ্চুপ বসেই ছিলাম, আসে পাশেই কোথাও আমার মায়ের তীব্র আর্তনাদ আমার কানে আসছিল না, আমার কান্নাও পাচ্ছিল না, মাদ্রাসার নিষ্ঠুর নির্যাতন আমাকেও সম্ভবত অনুভূতিহীন করে ফেলেছিল দিনের পর দিন; ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছিল বাবার হাত, নিঃসার হয়ে আসছিল। আমাকে কেউ বলে দেয়নি কোনদিন, তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল জন্মের পর এই হাতটা আমাকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল, আহারে, কোনদিন আর এই হাতের মমতামাখা স্পর্শ আমার জন্য থাকবে না। আমার বয়স তখন প্রায় ষোল বছর।

বাবার জানাজার নামাজ পড়াই আমি, বিচিত্র, অবর্ণনীয় একটা অনুভূতি হচ্ছিল তখন আমার। প্রচন্ড রোদের মাঝে বাবাকে কবর দিয়ে আসি, খুব একটা দুঃখ আমি পাইনি, তবে সেই বিচিত্র অনুভূতিটার আমি একটা নাম খুঁজে পাই- প্রতিজ্ঞা, যেটা আমার ষোল বছরের জীবনে আগে কখনো বোধ করিনি। আমি দ্রুত একটা অখ্যাত স্কুলের দারোয়ানকে চা-সিগারেট খাওয়ার টাকা দিয়ে একটা ক্লাস এইটের TC জোগাড় করি, এবং আরেকটা অখ্যাত স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বিভাগে। আমার মাদ্রাসার জীবন তখনো শেষ হয়নি, কোনভাবে মুচলেকা টুচলেকা দিয়ে ক্লাস টেনে ঊত্তীর্ণ হয়ে যাই স্কুলে, এদিকে শেষ করি বহু আনন্দ বেদনার দীর্ঘ মাদ্রাসা জীবন।

প্রথমদিন স্কুলে যাই যেদিন দশম শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হয় সেদিন। মাত্র হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে আসা একটি ছেলের জন্য অনেকটা স্বপ্নের মতো ছিল বিষয়টা, যে দীর্ঘ দিনের অব্যবহারে ভুলে গিয়েছিল কোনটা b আর কোনটা d, যার বিদ্যের দৌড় বলতে ক্লাস ফোর। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সর্বমোট ১১ নাম্বার পেলাম, এর মাঝে ইসলাম শিক্ষায় ১০ আর বাংলায় ১; বাকিগুলোতে ০০। স্কুল কর্তৃপক্ষ ডেকে বলে দিল, প্রি-টেস্ট পরীক্ষাতে পাশ না করলে আবারো ক্লাস নাইনে ফেরত যেতে হবে। সামনে তখন একটাই পথ খোলা ছিল আমার, দীর্ঘ আট বছরের মুখস্ত বিদ্যার পথ, যাবতীয় গাইড বই প্রশ্নোত্তর সহ মুখস্থ করে ফেললাম, ইংরেজি যেসব শব্দের উচ্চারণ করতে জানি না, সেগুলোর বানান সহ মুখস্থ করে ফেললাম। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, সমাজ...রাত দিন আমি পরিশ্রম করতাম, আমার ধারণা ছিল সবাই বুঝে পড়ে, শুধু আমিই মুখস্থ করি, তাই আমাকে যে কোন মূল্যে এই মুখস্থ বিদ্যা কাজে লাগাতে হবে। বিচিত্র বিষয় হচ্ছে, সেই দিনগুলো থেকে অনেকদিন পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে সবাই মুখস্থই করে, এই দেশের পাবলিক পরীক্ষা মানেই হচ্ছে মুখস্থ করার ক্ষমতা যাচাইয়ের পরীক্ষা, মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা নয়, এই দেশে 'মেধাবী' বলতে যা বোঝান হয় সেটার অর্থ মূলত 'তথ্য ধারণকারী', তথ্য প্রয়োগকারী নয়।

প্রচন্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে পরীক্ষা দিলেও ভালভাবেই পাশ করে যাই মাধ্যমিকের গন্ডি, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই অখ্যাত একটি কলেজে। একটা জেদ ছিল নিজের ভেতর, কিছু একটা করতে হবে, তাই মাধ্যমিকের পর একটি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবে যেতাম নিয়মিত, সেখানে ধীরে ধীরে চর্চা করতে করতে একটা সময়, উচ্চ মাধ্যমিকের পাট শুরু হওয়ার আগেই, দেখি আমি ইংরেজি বলতে পারি, শুধু পারি না, বেশ ভাল ভাবে পারি, অন্য সবার চেয়ে অনেক দ্রুত, এবং অনেক বিশুদ্ধ উচ্চারণে। তাই উচ্চ মাধ্যমিকে আমার ইংরেজি বিষয়ক চিন্তা ছিল না বললেই হয়, কারণ, ঐ ক্লাবে আমি শুধু ইংরেজি যে বলতাম শুধু তাই-ই না, আমি ইংরেজি ব্যকরণের যতগুলো বই বাজারে পাওয়া যেত সবগুলো খুব ভাল ভাবে আত্নস্থ করেছিলাম। সেটা আমার ভেতর একটা আত্নবিশ্বাস যুগিয়েছিল- আমি পারি। চেষ্টা করলে আমি পারি। চেষ্টা করলে সবাই পারে।

No comments:

Post a Comment

COUNTER W