Friday, February 17, 2012

আরেক দফা বিপিএল

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ওরফে বিপিএল কি সফল? না। পুরোপুরি সফল নয়। যেমন লোকারণ্য হবে বলে ভাবা হয়েছিল, যেমন পুরো দেশ মাতোয়ারা হবে বলে ফানুস ওড়ানো হচ্ছিল আদতে হয়নি তেমন কিছু। কাজেই সফল নয় মোটেও।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ওরফে বিপিএল কি ব্যর্থ? না। পুরোপুরি ব্যর্থ নয়। একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছে, খ্যাতিমান ক্রিকেটারদের অনেকেরই পদধূলি পড়েছে, মানুষও কিছু আনন্দ পাচ্ছে, কাজেই পুরোপুরি ব্যর্থ নয়।
মানে সমীকরণে যা দাঁড়াচ্ছে বিপিএল পুরো ব্যর্থও নয়, পুরো সফলও নয়। আধা সফল-আধা ব্যর্থ এবং টুর্নামেন্টের মাঝপথের এই অঙ্কে মনে হচ্ছে এটাই আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে ভালো হয়েছে। পুরোপুরি ফ্লপ হলে সমস্যা ছিল। তার চেয়েও বেশি সমস্যা ছিল পুরোপুরি সফল হলে। তাহলে আমাদের অপরিণামদর্শী আয়োজক এবং তাঁদের প্রিয় ব্যবসায়ী সঙ্গীরা মিলে এমনভাবে বিপিএল তথা টোয়েন্টি টোয়েন্টির ঢোল বাজাতে শুরু করতেন তার ভিড়ে আমরা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজই শুনতে পেতাম না। এত আয়োজন করে বিপিএলে যখন মানুষের স্রোত তৈরি করা যায়নি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের ধাক্কা খেয়েছেন, কাজেই এরপর হিসাব কষবেন। ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও জানবে এবং বুঝবে এ আর দশটা ব্যবসার মতো নয় যে বিনিয়োগে আর বিজ্ঞাপনে পুরোপুরি বিভ্রান্তি তৈরি সম্ভব। আবার পুরো ব্যর্থ হলে সেটাও শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য দুঃসংবাদ ছিল। খেলার যেকোনো আয়োজনের ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত খেলাটার জন্য সুখবর নয় কোনোভাবেই। কাজেই এই আধা ব্যর্থ-আধা সফল বিপিএলই বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো। আর টুর্নামেন্টটাকে এই পর্যায়ে নামিয়ে এনে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা জানিয়ে দিলেন, আমরা অতটা হুজুগে নই যতটা আমাদের কর্তারা ভেবে বসে আছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কি?) দেশের ক্রিকেটের ভালো-মন্দ বিচার তাদের চেয়েও আমরা ভালো করি এবং এ-ও তাঁরা ঘোষণার স্বরেই জানালেন যে আরেকটি দেশকে মডেল ধরে বাংলাদেশের সামাজিক চিন্তা এবং ক্রিকেটরুচিকে নির্ণয়ের চেষ্টা করা পুরোপুরিই ভুল। সেই ভুল করে আয়োজকরা ঘোল খেয়েছেন কিন্তু ঘোলকে সরবত ধরে এখনো খেয়েই চলছেন। সম্ভবত বদহজম হওয়ার আগ পর্যন্ত চলবে।
উদ্বোধনী দিনের কথা মনে করুন। শুরুতে বাপ্পি লাহিড়ি এবং শান। সঙ্গে খুব খারাপ দেখায় বলে বোধহয় কুমার বিশ্বজিৎকে রাখা হয়েছিল। তাঁরা তিনজন তিন রকম তিনটা কাগজ দেখে দেখে গান গাইছেন, দৃশ্য হিসেবে অত্যন্ত হাস্যকর। গানের কথা! টোয়েন্টি টোয়েন্টি আর ডিজুস যুগে নাকি সবই যায়, কাজেই আর খুব বেশি না-ই বা বললাম। আয়ুব বাচ্চু বড় গায়ক সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁকে দিয়ে ভাষার গান গাওয়ানোর পেছনের যুক্তি বা কুযুক্তিটা কি কে জানে! যাই হোক, এতটুকু পর্যন্ত তবু এক-আধটু বাংলাদেশ ছিল। এরপর বাকিটা ভারত! তাদের নাচ-গান, উল্লাস-উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এটা যেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রদর্শনী চলছে। ওদের আকাশ সংস্কৃতি যখন আমাদের শিশু-কিশোরদের রুচিবিকৃতি ঘটিয়ে চলছে, যখন ভারতের সিনেমার প্রবেশাধিকারে বাংলাদেশের সিনেমার কফিনে শেষ পেরেক ঢুকছে, তখন ক্রিকেটের নামে ভারত আর তাদের নায়ক-নায়িকাদেরই চেনানো হচ্ছে যেন! সেই ভারত, যারা এই টুর্নামেন্টে তাদের কোনো খেলোয়াড়কে খেলার অনুমতি দেয়নি। সেই ভারত, যারা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ওদের মাঠে টেস্ট খেলতে দেয়নি। অথচ বিপিএলের মোড়কে সেই ভারত আর তার সংস্কৃতিকে চেনানো-জানানোর দায়িত্ব নিয়ে বসেছেন যেন বাংলাদেশের দূরদর্শী আয়োজকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজিরাও পিছিয়ে নেই। কয়েক দিন আগে দেখলাম রিয়া সেন বা রাইমা সেন বাংলাদেশে এসেছেন সিলেটের সমর্থক হিসেবে। আশ্চর্য ব্যাপার! সিলেট নামটিই যিনি এর আগে হয়তো শোনেননি বা এরপর মনেও রাখবেন না হয়তো, তিনি এসেছেন সেই দলকে উদ্দীপ্ত করতে! বলিউডের দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আরো আসছেন এবং সম্ভবত আসতেই থাকবেন। টাকার বিনিময়ে আনা এসব ভাড়াটে সমর্থকদের দিয়ে যে ঠিক কী অর্জন করা যাবে কে জানে! সমর্থন অতি পবিত্র একটা জিনিস। এই একটা জায়গায়, অর্থাৎ খেলাধুলায় মানুষের সমর্থন হয় নিঃস্বার্থ এবং হৃদয়ের আবেগ মেশানো। এই আমরাই তো দেখেছি বাংলাদেশে আবাহনী-মোহামেডানকে হৃদয়ের সবটা দিয়ে সমর্থন করে বাংলাদেশের মানুষ কি পাগুলে কাণ্ডই না করে! এই আমরাই তো দেখি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কী প্রাণের টানে স্রোতের মতো স্টেডিয়ামের দিকে ছুটে চলে মানুষের মিছিল। সেখানে নাকি মেকি আবেগ দেখাতে ভাড়া করে বিদেশ থেকে লোক আনতে হয়! দেশিদের মধ্যেও ভাড়াটে আছেন অনেক। নায়ক-গায়করা দেখছি বিভিন্ন দলের অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন। আচ্ছা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর নাম ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট রাখা হয়েছে কেন? সে অঞ্চলের সব মানুষ এই দলটার পেছনে থাকবে এ জন্যই তো! এখন সেই অঞ্চলের একজন নামকরা নায়ক যদি অন্য অঞ্চলের একটা দলের হয়ে গলা ফাটান তাহলে সমর্থন নামের নির্দোষ আবেগটাকেই তো অসম্মান করা হয়! আইপিএলের উদাহরণ দেবেন! জানিয়ে রাখি, আইপিএল ব্যবসায়িক সাফল্যের মডেল হতে পারে (হয় বলেই তালিকায় সবচেয়ে নিচে থাকা দলটি সবচেয়ে বেশি আয় করে) কিন্তু ক্রিকেট বা ক্রিকেট সংস্কৃতির জন্য বিষবৃক্ষ। এবং আগেই বলেছি বাংলাদেশকে আরেক দেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা অন্যায় এবং ভুল। তারকা সমর্থক অনেক বড় দলের আছেন, তাঁরা মাঠে আসেন। কিন্তু মনে রাখবেন, রাফায়েল নাদাল টাকার বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদকে সমর্থন করতে আসেন না! আর নাদাল কিন্তু রিয়ালেরও আগে মায়োরকার সমর্থক। কারণ ওখানে তাঁর নিজের বাড়ি। নিজের ঘর।
খুব গর্বের সঙ্গে দাবি করি খেলাধুলা পৃথিবীর বিশুদ্ধতম শিল্প এবং শ্রেষ্ঠতম বিনোদন মাধ্যম। এসব আইপিএল-বিপিএল দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে মনে হয় খেলার এই সৌন্দর্যটাকে, এই অহংকারটাকে কী নির্মমভাবে ভূলণ্ঠিত করা হচ্ছে। ক্রিকেট চলছে, বিশ্বসেরা ক্রিকেটাররা খেলছেন, তবু নাকি আনন্দের জন্য চিয়ার গার্ল লাগে। পৃথিবীর আর কোনো খেলায় কিন্তু লাগে না। ক্রিকেটেও কিন্তু এই সেদিনও লাগত না। তখনকার ক্রিকেট কি বিনোদনদায়ী ছিল! ব্র্যাডম্যান-সোবার্স থেকে শুরু হয়ে রিচার্ডস-ইমরান-গাভাস্কার-কপিল-টেন্ডুলকার-লারা-ওয়ার্নরা কি কম বিনোদনের ফেরি করেছেন! তবু কিছু মানুষের অদ্ভুতুড়ে চিন্তায় আজ চিয়ার গার্ল লাগে, আজ বিদেশি সিনেমার নায়ক-গায়ককে ভাড়া করে আনতে হয়! কর্তাদের কাছে এরা মণি-মুক্তো হতে পারেন কিন্তু মানুষের কাছে এঁদের মূল্য পাথরকুচির চেয়ে বেশি কিছু নয়। খেয়াল করুণ, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেদিন সবচেয়ে বেশি নাচ-গান হলো সেদিন মানুষ সবচেয়ে কম। এরপর ক্রিকেটের দেখা যখন মিলল বিপিএলে তখন থেকে মানুষ কিছুটা মাঠমুখী। তার মানে, আমাদের মানুষকে কর্তারা যতটা হুজুগে ভেবে বসে আছেন মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। আর যাঁদের আমরা শিক্ষিত ভেবে বসে আছি তারা আসলে অনেক বেশি অসচেতন। তাই ঘোল খেয়ে চলছেন কিন্তু ঘোলটাকে এখনো সরবত ভেবে চলছেন। বদহজম হওয়ার অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
পুনশ্চ ১ : বিপিএলের পক্ষে খুব প্রচার চালানো হয়েছিল যে এখানে আমাদের তরুণ ক্রিকেটাররা নিজেদের মেলে ধরবে। বেশ কয়েকজনের দেখা মিলবে। কোথায়? খুঁজে তো পাচ্ছি না।
পুনশ্চ ২ : আমরা বরং দেখছি রিটায়ারমেন্টে যাওয়া পার্টি ক্রিকেটার এবং অন্য দেশের অখ্যাত তরুণদের প্রদর্শনী। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না আমাদের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটাররা। আমাদের আইকনদের চেয়ে ওদের কার্যকারিতা বেশি, বিপিএল যদি হয়ে থাকে এই অপ্রিয় সত্য প্রমাণের জন্য তাহলে কিন্তু আয়োজকরা সফল। এখানে আর আংশিক নয়, পুরো সফল।

No comments:

Post a Comment

COUNTER W