Friday, March 9, 2012

দাওয়াত ও তাবলীগে নারীদের ভূমিকা- ১ম পর্ব

যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারী জাতি নানাভাবে উপেক্ষিত, নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয়ে এসেছে। পুরুষরা নারীকে বাদ দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ও বাস্তবায়ন করেছে। চাই সমাজে শান্তি আসুক বা না আসুক। সতেরশ শতাব্দীতে রোম শহরে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যে বৈঠকের নাম ছিল Council of the wise ‘জ্ঞানীদের অধিবেশন’। উক্ত অধিবেশনে জ্ঞানীরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, Women has no soul ‘নারীদের আত্মা নেই’। নারীদের ব্যাপারে যখন রোমের জ্ঞানীদের এই ধারণা, তখন বোঝাই যায় সাধারণ মানুষ তাদের সাথে কি আচরণ করত! ইহুদী ধর্মে নারীকে ‘পুরুষের প্রতারক’ বলা হয়েছে। ইউরোপীয়রা নারীকে ‘শয়তানের অঙ্গ’ মনে করত। গ্রীক সমাজের প্রাণপুরুষ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসও মনে করতেন- Women is the greatest source of chaose and disruption in the world ‘পৃথিবীতে বিশৃংখলা ও বিভেদের সর্ববৃহৎ উৎস হ’ল নারী’।

কিন্তু ইসলাম সম্পূর্ণ এর বিপরীত। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা কিনা পুরুষের সাথে সব কাজেই নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন ও মুমিনা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে বাধা দেয়’
{তওবা ৭১}। ওমর (রা.) বলেন, ‘আমরা জাহেলী যুগে নারীদেরকে কোন হিসাবেই ধরতাম না। অতঃপর যখন ইসলাম আসল এবং (কুরআনে) আল্লাহ তাদের (মর্যাদার) কথা উল্লেখ করলেন, তাতে আমরা দেখলাম যে, আমাদের উপর তাদের হক আছে’।*১* শরী‘আতের সব বিধানেই নারী শামিল রয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর যুগে এক্ষেত্রে নারীদের উল্লেখযোগ্য পদচারণা ছিল। নিম্নে এ প্রসঙ্গে আলোচনা উপস্থাপন করা হ’ল।

দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব :

ইসলামকে সর্বত্র পৌঁছে দিতে দাওয়াত ও তাবলীগের বিকল্প নেই। প্রচারের কাজটি যত সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়, প্রসারের কাজটিও তত সহজ হয়। কুরআন ও হাদীছে এ বিষয়ে ব্যাপক তাকীদ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা প্রয়োজন, যারা (মানুষকে) কল্যাণের পথে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। বস্তুতঃ তারাই হবে সফলকাম’ {আলে ইমরান ১০৪}। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার নিকট যা নাযিল হয়েছে তা পৌঁছে দিন। আপনি যদি এরূপ না করেন, তাহ’লে আপনি রিসালাতের বাণী পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের নিকট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের পথ দেখান না’ {মায়েদা ৬৭}।

যারা জানে অথচ মানুষকে জানায় না তাদের উপর আল্লাহ লা‘নত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যে সমস্ত সুস্পষ্ট বিষয় ও হেদায়াতের বাণী মানুষের জন্য নাযিল করেছি, কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পরও যারা (মানুষ থেকে) গোপন রাখে তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত’
{বাক্বারাহ ১৫৯}।

এ ব্যাপারে হাদীছেও বিভিন্নভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা বা উপদেশ দেয়ার নাম। আমরা (ছাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? রাসূলুল্লাহ (ছা.) বললেন, আল্লাহ, তাঁর রাসূল, মুসলিম নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের জন্য।
*২*

উল্লেখ্য, আল্লাহর কল্যাণ কামনা দ্বারা তাঁর প্রতি খালেছ ঈমান আনা ও ইবাদত করা বুঝায়। রাসূলের কল্যাণ কামনার অর্থ হ’ল রাসূলের আনুগত্য করা। মুসলমান নেতাদের কল্যাণ কামনার মাধ্যমে ভাল কাজে তাদের আনুগত্য করা ও তাদের বিদ্রোহ না করা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনা দ্বারা তাদের উপদেশ দেয়া বুঝায়।


অন্য হাদীছে এসেছে, জারীর বিন আব্দিল্লাহ (রা.) বলেন, আমরা রাসূল (ছা.)-এর নিকট ছালাত প্রতিষ্ঠার, যাকাত প্রদানের, নেতার আদেশ শোনার ও তাঁর আনুগত্য করার এবং প্রত্যেক মুসলমানকে উপদেশ দেয়ার শপথ গ্রহণ করলাম’।
*৩*

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, ‘একটি আয়াত হ’লেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। বনী ইসরাঈলের নিকট থেকে বর্ণনা কর, কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার উপরে মিথ্যা আরোপ করবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।
*৪* হাদীছটিতে দাওয়াতের গুরুত্ব ফুটে ওঠেছে। সেই সাথে এ বিষয়েও সাবধান করা হয়েছে যে, তাতে যেন মিথ্যার লেশমাত্র না থাকে। নতুবা তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।

বিদায় হজ্জের ভাষণেও রাসূলুল্লাহ (ছা.) একই নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়’।
*৫*

অতএব দ্বীনকে চির জাগ্রত রাখার জন্য দাওয়াত দান অত্যাবশ্যক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।


দাওয়াত ও তাবলীগের ফযীলত :

আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দানের বহুবিধ ফযীলত রয়েছে। যেগুলো পড়লে বা শুনলে মুমিন হৃদয় দাওয়াত দানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, শত ঝঞ্ঝাট উপেক্ষা করেও দাওয়াতী ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ঐ পরিমাণ নেকী পাবে, যতটুক নেকী পাবে ঐ কাজ সম্পাদনকারী নিজে’।*৬*

খায়বার যুদ্ধের সেনাপতি আলী বিন আবু তালিবকে নছীহতের পর রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটা তোমার জন্য লাল উটের (কুরবানীর) চেয়েও উত্তম হবে।
*৭*

উট ছিল আরব মরুর উৎকৃষ্ট বাহন ও উত্তম সম্পদ। তন্মধ্যে লাল উট ছিল আরো মূল্যবান। এজন্য হাদীছে লাল উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।


আবূ হুরায়রা (রা.) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে মানুষকে ডাকে তার জন্য ঠিক ঐ পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ ছওয়াব পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীগণের ছওয়াব সামান্যতম কমবে না। আর যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার পথে কাউকে ডাকবে সে ঠিক ঐ পরিমাণ গোনাহ পাবে, যে পরিমাণ গোনাহ পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীদের গুনাহ সামান্যতম হ্রাস করা হবে না’।
*৮*

অন্যত্র রাসূল (ছা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভাল নিয়মের প্রচলন করল, সে তার নেকী পাবে এবং পরে যারা এরূপ আমল করবে তাদের সমপরিমাণ নেকীও সে পাবে। কিন্তু তাদের (অনুসরণকারীদের) নেকী কিছুমাত্র কম হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ নিয়ম চালু করবে, সে তার গোনাহ পাবে এবং পরবর্তীতে যারা এরূপ আমল করবে, তাদের সম পরিমাণ গোনাহও সে পাবে। কিন্তু তাদের গোনাহ বিন্দুমাত্র কম করা হবে না’।
*৯*

আলোচ্য হাদীছে ‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভাল নিয়মের প্রচলন করে’ দ্বারা বিদ‘আতে হাসানা বুঝানো হয়নি। কেউ কেউ এটা দিয়ে বিদ‘আতে হাসানার দলীল দিয়ে থাকেন। অথচ বিদ‘আতের কোন প্রকারভেদই নেই। মন্দের আবার ভাল হয় কি করে? রাসূল (ছা.) সকল বিদ‘আতকেই ভ্রষ্টতা বলেছেন।
*১০* দ্বিতীয়তঃ এই হাদীছের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আগে থেকেই প্রমাণিত ছহীহ দলীলভিত্তিক কোন আমল নতুনভাবে চালু করা। যেমন মাগরিবের পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত ছালাতের কথা আজ মানুষ ভুলতে বসেছে। কেউ যদি উক্ত ছালাতের শিক্ষা কাউকে দিয়ে থাকে, তাহ’লে আমলকারীর অনুরূপ ছওয়াব ঐ ব্যক্তি পাবে। হাদীছের উদ্দেশ্য এটাই।

No comments:

Post a Comment

COUNTER W